Sunday , December 3 2023
Home / আক্কেলপুর / ৫০০ বছরের ঐতিহ্য গোপীনাথপুর দোলপূর্ণিমা মেলা

৫০০ বছরের ঐতিহ্য গোপীনাথপুর দোলপূর্ণিমা মেলা

প্রতিবেদক, জয়পুরহাট নিউজ ২৪

৫০০ বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী গোপীনাথপুর দোলপূর্ণিমা মেলা গতকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে। জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে গোপীনাথপুর ইউনিয়নের গোপীনাথপুর মৌজায় বিশাল এলাকাজুড়ে এ মেলা বসেছে। ঐতিহ্যবাহী এ মেলা ঘিরে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ভুলে দূর-দূরান্তের দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে এই আয়োজন। প্রতিবছর দোলপূর্ণিমার দিন থেকে মেলাটি শুরু হয়। এবার মেলাটি ১৩ দিনব্যাপী চলবে। মেলা শুরু হয়েছে ৭ মার্চ চলবে ১৯ মার্চ পর্যন্ত।
গোপীনাথপুর দোলপূর্ণিমা মেলা কমিটি ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গোপীনাথপুর মন্দির ঘিরে প্রায় ৫০০ বছর আগে থেকেই দোলপূর্ণিমার দিনে মেলা বসে আসছে। তবে মেলাতে ঘোড়া হাট বসছে ৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে। দেশের সবচেয়ে বড় একমাত্র ঘোড়া বিকিকিনির হাট এটি। এ কারণে সারা দেশ থেকে আনা কয়েক হাজার ঘোড়া জড়ো করা হয় এখানে। বিগত কয়েক বছর ধরে মেলার প্রধান আর্কষণ ছিল যাত্রা-সার্কাস। তবে এবার মেলায় যাত্রা-সার্কাস না আসলেও ভ্রাম্যমাণ নৌকা, নাগরদোলা, ট্রেন, জাম্পিং, সাইকেল ও প্রাইভেটকার প্রদর্শনী এসেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মহারাজা, বাদশা, কদমরানী, রাজ, বিজলী, কিরণমালা, বারুদ, ডলামনি, সুন্দরী একেকটি ঘোড়ার একেকটি বাহারি নাম। ওদের ক্ষিপ্রতা আর বুদ্ধিমত্তায়ও মেলে নামের সার্থকতা। চলনে বিদ্যুতগতি। চোখের পলকে মাইল পার হতে জুড়ি নেই। আর নানামুখী গুণের কারণে ওদের কদরও যথেষ্ট। পছন্দের প্রাণীটিকে পেতে ক্রেতাদের মধ্যে রীতিমতো কাড়াকাড়ি।
এমনই চিত্র লক্ষ করা গেছে আক্কেলপুর-বগুড়া আঞ্চলিক সড়কের পশ্চিম পাশে গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের পাশে ফাঁকা জায়গাসহ প্রায় এক একর জায়গাজুড়ে বসেছে এ ঘোড়ার হাটে। এবারও নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নত জাতের ঘোড়া মেলায় এসেছে। তবে এবার মেলায় ছোট আকারের ও মাঝারি আকারি ঘোড়া বেশি এসেছে। কোন কোন দর্শনার্থী মেলায় ঘোড়া দেখছেন। কেউ ঘোড়ার দাম হাঁকাচ্ছন। আবার কোন ক্রেতার সঙ্গে দরদাম মিলে গেলে সেই ঘোড়া বিক্রি করে দিচ্ছে। এছাড়া রাস্তার পশ্চিম ও পূর্ব পাশে বিশাল জায়গাজুড়ে বসেছে গরু, মহিষের হাট। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বড় বড় গরু, মহিষ ও গাড়ল নিয়ে এসেছেন বিক্রেতারা। সেগুলো দেখতে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। আবার অনেক ক্রেতা তার পছন্দের প্রাণীকে কিনতে বিক্রেতার সঙ্গে দর কষাকষি করেছে। দরদামে মিলে গেলে পছন্দের প্রাণীকে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।
মেলায় এবার সবচেয়ে বড় দুটি ঘোড়া ভারত থেকে আমদানি করা লাল ও সাদা রঙের মহারাজা, সাদা ও কালো রঙের বাদশা। এ দুটি ঘোড়া নিয়ে এসেছেন রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আবু বক্কর সিদ্দিক। তিনি বলেন, পাঁচ বছর ধরে এ মেলা করছি। এবার দুটি ঘোড়া নিয়ে এসেছি। মহারাজার দাম সাড়ে ৭ লাখ ও বাদশার দাম সাড়ে ৬ লাখ টাকা হাঁকিয়েছেন। দরদামে মিলে গেলে বিক্রি করে দেবেন।
নওগাঁর ধামুরহাট থেকে দুটি ঘোড়া নিয়ে এসেছেন শাহরিয়ার ইসলাম। লাল ও সাদা রঙের ঘোড়াটা দেখতে অনেক সুন্দর। ঘোড়ার নাম রেখেছেন কদমরানী, আরেকটার নাম বারুদ। তিনি বলেন, কদমানীর দাম আড়াই লাখ টাকা ও বারুদের দাম ৭০ হাজার টাকা হাঁকিয়েছেন। এখন পর্যন্ত কদমরানীর দাম ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা ও বারুদের দাম ৫০ হাজার টাকা ওঠেছে। দরদামে মিলে গেলে বিক্রি করে দেবো।
বগুড়ার সান্তাহার থেকে এসেছেন রাসেল হোসেন। তিনি বলেন, মেলায় ঘোড়ার হাটে এসেছি। ৫২ হাজার টাকায় একটি মাঝারি আকারে ঘোড়া কিনেছি। ঘোড়ার নাম সুন্দরী।
মেলায় নওগাঁর মহাদেবপুর থেকে ছয়টি মহিষ নিয়ে এসেছেন রেজাউল ইসলাম। তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ মেলা ১৮ বছর ধরে করছি। এখন পর্যন্ত এক জোড়া মহিষের দাম ওঠেছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
মেলায় সবচেয়ে বড় মহিষ নিয়ে এসেছেন রাজশাহীর ইউসুফপুরের মাইনুল ইসলাম মিন্টু। তিনি বলেন, ২০ বছর ধরে এ মেলা করছেন। এবার বড় তিনটি ও ছোট আকারের ৪০টি মহিষ নিয়ে এসেছেন। বড় একজোড়া মহিষের দাম হাঁকিয়েছেন ১৫ লাখ টাকা।
গোপীনাথপুর বাজারের কড়ইতলী সড়কের দুই পাশের ফাঁকা জায়গায় শাড়ি, কাপড়, গার্মেন্টেস, কম্বলের দোকান। এছাড়া মেলায় ব্যাগ, জুতা, ছাতা, গৃহস্থালি সামগ্রী, মসলা, কাঠের ও প্লাস্টিকের আসবাবসহ নানা রকমের দোকানপাট বসেছে। এসব দোকানি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার। তারা দোলপূর্ণিমা শুরুর দুই দিন আগেই এখানে এসে দোকানঘরের বরাদ্দ নিয়েছেন। বাজারের ভেতরে রাস্তার দুই পাশে বসেছে নানা পদের মিষ্টান্নের দোকান। সেখানে কদমা, খাজা, মুড়কি, নানা পদের মিষ্টিসহ বর বড় আকারের মাছের মিষ্টি নিয়ে বসেছেন দোকানিরা।
চিশতিয়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী মোসলেম উদ্দিন বলেন, এবার মেলায় ৫ কেজি থেকে ১১ কেজি ওজনের মাছের মিষ্টি নিয়ে এসেছি। এছাড়া নানা পদের মিষ্টি রয়েছে। প্রতি কেজি মিষ্টি ১৬০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
দর্শনার্থী সোহেল রানা বলেন, এ ঐতিহ্যবাহী মেলা অনেক পুরনো। এ মেলার নাম অনেক শুনেছি। এজন্য বগুড়ার নন্দীগ্রাম থেকে বন্ধুদের নিয়ে দেখতে এসেছেন। মেলাটি সত্যি অনেক বড় ও সুন্দর। এছাড়া এমেলায় সব ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। এছাড়া বড় ঘোড়া, মহিস, গরু পাওয়া যায়।
গোপীনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে গোপীনাথপুর দোলপূর্ণিমা মেলা কমিটির সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, ঐতিহ্যবাহী গোপীনাথপুরের দোলপূর্ণিমা প্রায় ৫১৫ বছরের পুরনো। এত বড় আর পুরোনো মেলা উত্তরবঙ্গের কোথাও নেই। এ মেলাকে ঘিরে আনন্দ উৎসবের এক মিলনমেলা শুরু হয়। মেলায় লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে।
জয়পুরহাট পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ নূরে আলম বলেন, গোপীনাথপুর দোল পূর্ণিমা মেলা অনেক পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী মেলা। মেলার নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অতিউৎসাহী কার্যকলাপের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী এ মেলার ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করা হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

About Joypur Hat

Check Also

সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে:হুইপ স্বপন

  জাতীয় সংসদের হুইপ ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি …