জয়পুরহাটের কৃতি সন্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক শাহনাজ আখতার রানু।শাহনাজ রানুর আরেক পরিচয় তিনি একজন লেখক।২০১৯ সালের বইমেলায় সময় প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে তার প্রথম প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ “নোনতা চোখের গল্প”।গত বছরের বই মেলায় একই প্রকাশনী থেকে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ “প্রযত্নে কালো শাড়ি’ ।
আজ পড়ে নেওয়া যাক শাহনাজ রানুর একগুচ্ছ কবিতা
বিধাতার প্রবঞ্চনা
মিথ্যে মমতায় বুকের জমিন যখন চিচিংফাঁক
তখন সীতার বিসর্জনেই কী,
আর রাধার ক্রন্দনেই বা কী!!
এই একবিংশ শতাব্দীতে
সকল বঞ্চনা আর দ্বিধার বোঝা কাঁধে নিয়ে
আবার আমি নারী হয়ে জন্মেছি!
সমুদ্রসম বেদনা আর পাহাড়সম ধৈর্য নিয়ে
বয়ে চলেছি বিধাতার দেয়া খয়রাতি এই জীবন!
তাতেই বা কী এসে যায়!
রোমিওর জন্য জুলিয়েট আর
মজনুর জন্য লাইলি মরে যায়-
হয়ে যায় অমর কাহিনি-
সত্যি কি তাই?
এই যে প্রতি মুহূর্তে আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে
ধাপে ধাপে পিছিয়ে চলেছি-
তাতেই বা কার কী?
আমাকে বোঝাতে আইন, শাসাতে ফাইন-
তুমি রাজনীতি বোঝাও, বোঝাও ধর্ম-
যেন আমাকে ঢাকলেই সভ্যতা মুক্তি পায়
যেন ফিরে পায় ফারাও রাজার অমরত্ব-
হায় পুরুষ – হায় বিধাতা!
একদিন বোঝাপড়া করি আয়-
দেখে যা,জেনে যা
‘প্রভুত্ব যতটা আনন্দের-
নারীত্ব ততটাই কন্টকময়!’
২৩ নভেম্বর ২০২০
অদ্ভুত আবাস
বড় অদ্ভুত এলোমেলো সে বাসা
ছোট্ট একটা আবাস-
অনেক বড় রহস্যে ভরা!
যত্রতত্র ছড়ানো বিচিত্র ভালোবাসার আঁচড়-
দেয়ালে সাজানো পাখির বাসা,
শোকেসে মোমবাতির আসর,
আয়নায় ফেলে যাওয়া সবুজ বড় টিপ-
ঘরের মধ্যে কারো পাঠানো একগাদা ভালোবাসা-
লিপবাম থেকে ঝলমলে গামছা-
বর্ণিল বাক্সে ঠাসাঠাসি প্রেম!
বারান্দায় কারো যত্নে লাগানো ক্যাকটাস!
হুম,ফুল ফুটেছে তাতেও-
যদিও সে দেখেছে কি না
জানা নেই মোটেও!
ফ্রিজের ওপরে রেখে যাওয়া চিরুনি!
কী ভীষণ এলোমেলো অথচ গোছানো একাকিত্ব!
এর মধ্যেই তার বসবাস!
এর মধ্যেই নিত্যনতুনের আনাগোনা-
সিগারেট-সুরা-সাকি
কবিতার বই বা হোমো স্যাপিয়েন্স-
কারো পাঠানো রাশি রাশি প্রেমপত্র-
অদ্ভুত সেই নিবাসে কতো মায়া!
অথচ ফাঁকা সব-
আনাচে কানাচে পড়ে থাকা সকল প্রেমেই
কেবল গোলকধাঁধার কেচ্ছা-
আমি শূন্যতা দেখেছি,দেখেছি দমবন্ধ যন্ত্রণা-
হয়তো বোঝে সেও
কিংবা মেনে নিয়েছে অচল কড়িতে কেনা প্রেম!
অদ্ভুত সেই আবাস তার!
আর অদ্ভুত তার আনাগোনা!
১৩ ডিসেম্বর ২০২০
চাইছি তোমায়…
কী ভীষণ ভাবছি তোমায়—
হঠাৎ এলোমেলো, অস্থির চলে আসো যখন
আমার বুকের ভেতর একশ ঘণ্টা বেজে ওঠে একসাথে।
মুহূর্তে চোখ বন্ধ করে ফেলি-
যেন অন্ধ হয়ে যাবো তোমার আলোয়!
জানি, তুমি ভাবছো আমি প্রেমে পড়েছি!
কী জানি! হবে হয়তো!
এই যে সকল কিছুর মাঝে তোমায় খোঁজা,
অথবা মুঠোফোনে তোমার অন্তর্জালের অপেক্ষা-
প্রেম? পূজা? অথবা পাপ?
আমি বুঝি না কিছুই।
অসম্ভব হয়ে পরে নিঃশ্বাস নেয়া!
যেন অক্সিজেনের ঘাটতি জগৎ জুড়ে!
কী ভীষণ চাইছি তোমায়-
এই অন্ধকারের ভেতর, স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে
তুমি আমার একমাত্র ভেজা জোছনা!
পাতায় পাতায় যেন গল্প হয়ে আসো তুমি-
দেখিয়ে দাও- জানিয়ে যাও
কতোটা শূন্য চারপাশ তুমি ছাড়া!
ভেবেছিলাম এভাবে গোপন বেদনায় হারিয়ে যাবে
আস্ত একটা জীবন!
তুমি এসেই ধাঁধিয়ে গেলে চোখ-
নেড়ে গেলে সকল মিথ্যে চেতনার দুয়ার।
বলে গেলে- জীবন সুন্দর।
আমার পারসিয়ান প্রজাপতি,
যে ক্ষণিকে তোমার অস্তিত্বের সুঘ্রাণ নেই-
আমার সেখানে মরণ হয় প্রতিনিয়ত!
আমার সামনে এসো-
জয় করো সকল জল আর স্থল-
তারপর- এসো অমর হই।
১৭ মার্চ ২০২১
প্রেম ছিলো না
এই যে তার চলে যাওয়ায়
কষ্ট হলো না তেমন কেন?
তার মানে সে মিথ্যে ছিলো-
ফিকশন ছিলো নতুন যেন!
দিন শেষে তার নতুন ডায়েরি লিখা-
নতুন পাতায় নতুন কবিতা-
নাহ, আমায় ভাবালো না তো!
তার মানে সে মায়া ছিলো-
মিথ্যে কোন ছায়া ছিলো!
এই যে হঠাৎ ডাক না শোনা-
ক্যামোফ্লাজের জরিপ টানা-
এক সকালের নৌকাভ্রমণ-
কিংবা চাঁদের আলোয় রোদন!
মিথ্যা ছিলো আপাদমস্তক-
কই,তবু তো বুক ফাটে না?
মনের কোণে কোথাও তার
কথার যাদুর বীণ বাজে না—
সবই তবে মোহ ছিলো –
প্রেম ছিলো না, প্রেম ছিলো না!
১১ এপ্রিল ২০২১
চক্রকাল
যে তারাটা খসে পড়লো মাত্র
মাঝে মাঝে নিজেকে তার দোসর মনে হয়!
যার উৎপত্তি আর গন্তব্য দুটোই অজানা!
হারিয়ে যাওয়া যেন কোন অদ্ভুত কৃষ্ণগহ্বরে-
না চিহ্ন ছেড়ে যাওয়া,
আর না রেখে যাওয়া কোন ঠিকানা!
কখনো বা চেতন আর অবচেতনের
সীমানা ভেঙে যায়-
স্বপ্ন হয়ে ওঠে বাস্তব-
আর বাস্তবতা হয় গুহার আঁধারে সেই কল্পলোক!
আমার মহাকাশ থেকে যায় কখনো বা-
অথবা হারিয়ে যায় কালান্তরের ধাঁধায়!
নিস্তব্ধ পরিক্রমায় আমি শোরগোল করি না-
অস্তিত্বের গোলকে বরং যাপন করি চক্রকাল-
খসে পরলেও আমি ফিরে আসি আবার-
চেতনার বৃত্তে আমি কেন্দ্র হই বারবার!
২৪ এপ্রিল ২০২১