এলিজা বিনতে এলাহী
নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের বিভিন্ন নদনদী, প্রাচীন দিঘি ও জলাশয়গুলো সেই অঞ্চলের মনুষ্য বসবাসের আদি পরিচয় বহন করে। কারণ পৃথিবীর সব প্রাচীন সভ্যতাই নদনদী ও বিভিন্ন জলাশয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।
উত্তরবঙ্গের আইকনিক শহর নওগাঁ। নওগাঁ জেলায় সুবিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলোর পাশাপাশি রয়েছে দুটি প্রাচীন দিঘি- একটির নাম আলতা দিঘি, অন্যটি দিবর দিঘি। আয়তনের বিচারে আলতা দিঘি বাংলাদেশে টিকে থাকা প্রাচীন দিঘিগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ। তবে আজকের গল্পটি দিবর দিঘি দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে। কারণ দিবর দিঘি নিজস্ব স্বকীয়তা অর্জন করেছে দিঘির মাঝে রহস্যাবৃত একটি গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভের জন্য।
প্রমাণের অভাবে এই জয়াশয়গুলোর ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলা যায় না। যেটুকু জনশ্রুতি, কথা-উপকথা রয়েছে সেগুলো প্রতিটা দিঘির ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম। তাই সেগুলোর ওপর বিশেষ নির্ভর করা যায় না। নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পৃথিবীর বিস্ময়কর কীর্তি দিবর দিঘি স্তম্ভ।
পৃথিবীর বিস্ময়কর কীর্তি! শুনতে একটু কেমন ঠেকছে তাই না! এটি আমার কথা নয়, বলেছেন দেশ-বিদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকরা। ২০১৯ সালের জুন মাসে আমি উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ করেছি ৬৪ জেলা হেরিটেজ ভ্রমণের মিশন নিয়ে। জয়পুরহাট ভ্রমণ শেষে নওগাঁ জেলার ভ্রমণ শুরু করেছিলাম দিবর দিঘির মাধ্যমে। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছলাম দিবর দিঘির পাড়ে। খালি চোখে দূর থেকে দেখতে বর্গাকার লাগছিল দিঘিটা। আগে এর বিস্তৃতি কতটুকু ছিল সেটি জানা যায়নি। এখন জলাশয়টির আয়তন প্রায় ২০ একরের মতো হবে- এমনটি বিভিন্ন বইতে লেখা পেলাম।
দিঘির মধ্যখানে পাড় থেকেই স্তম্ভটি দেখতে পাচ্ছিলাম। কাছে গিয়ে ভালো করে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করছিল। উপায় খুঁজছিলাম, ঘাটের কয়েকটা সিঁড়ি নামতেই দেখলাম একটি নৌকা বাঁধা রয়েছে। প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার এ রকম সুকঠিন অখণ্ড গ্রানাইট পাথর সম্ভবত বাংলাদেশে একটিই রয়েছে। ইংরেজ প্রত্নতত্ত্ববিদ ডক্টর ফ্রান্সিস বুকানন ১৮০৭ সালে ভারত ভ্রমণের সময় দিবর দিঘি স্তম্ভ পরিদর্শন করেন। এরপর বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার অ্যালেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৭৯ সালে দিবর দিঘি স্তম্ভ দেখতে আসেন। দু’জনই একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেন যে, স্তম্ভটি একটি অখণ্ড গ্রানাইট পাথর। ১৯৯০ সালের দিকে একবার দিবর দিঘিকে পুনঃখননের জন্য পানিশূন্য করা হয়েছিল। করার পর দেখা যায়, দিঘির তলদেশে মাটির নিচে স্তম্ভটি সাতটি ধাপে নির্মিত হয়েছে। এ কারণেই হয়তো পানিভর্তি একটি জলাধারের নরম মাটিতে অবস্থিত থাকা সত্ত্বেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ১২ ফুট লম্বা স্তম্ভটি এক তিলও না নড়ে স্থিতিশীল আছে।
এখন প্রশ্ন আসে, কে এই স্তম্ভ নির্মাণ করলেন এবং কেনইবা দিঘির মাঝে স্তম্ভটি নির্মাণ করা হলো। এই স্তম্ভের নির্মাণকাল বা নির্মাতা সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। রয়েছে কিছু জনশ্রুতি। একটি জনশ্রুতি হলো, ১১ শতকে কৈবর্ত রাজবংশের তৃতীয় ও শেষ নৃপতি ভীম এই দিঘি খনন ও স্তম্ভ স্থাপন করেন।
হয়তো এটি সঠিক নয়, কারণ বিশ্ব প্রত্নতত্ত্ব গবেষকরা একে অখণ্ড গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ বলছেন। গ্রানাইট পাথর পাওয়া যায় শুধু দক্ষিণ ও মধ্য ভারতে। দক্ষিণ ও মধ্য ভারত থেকে এই পাথর আনা সম্ভব নয়। প্রবল প্রতাপশালী পালবংশের রাজারাও বেলে পাথর দিয়েই কাজ করতেন। প্রকৃতপক্ষে গুপ্ত সম্রাটদের পর ও মোগলদের আগে বাংলায় গ্রানাইট পাথর আমদানির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
কেউ কেউ বলেন, তৃতীয় পাল রাজা দেব পালের কীর্তি ছিল এটি; এ কারণে এর আদি নাম ছিল ‘দেবের দিঘি’। অপভ্রংশ হয়ে হয়েছে দিবর দিঘি।
এই পাথর খণ্ড সম্পর্কে স্যার কানিংহাম যা বলেছেন সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো ‘৩০ ফুটের মতো লম্বা এত বিরাট অখণ্ড একটি পাথর সম্রাট অশোকের সময়ের পর এ অঞ্চলে আর দেখা যায়নি। আমার কাছে এটিকে অশোকের মনোলিথগুলোর একটি মনে হয়েছে।’