
জয়পুরহাটের কৃতি সন্তান ড. মো: জহুরুল ইসলাম।একজন অনুজীব বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ।পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক হিসেবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রতে কর্মরত আছেন ।এছাড়া বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে শিক্ষাছুটিতে কর্মরত ।তার সহধর্মিনী ড. শাহানা আহমেদ।
সম্প্রতি ড.জহুরুল ইসলামের মুখোমুখি হয় জয়পুরহাট নিউজ টুয়েন্টিফোর।দীর্ঘ আলাপে নানা বিষয়ে তার সাথে কথা বলেছেন সম্পাদক Rabiul Islam Rimon তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
জহুরুল ইসলামের বেড়ে ওঠা জয়পুরহাট জেলার কালাই থানাধীন মুড়াইল গ্রামের এক কৃষক পরিবারে,পিতা মো: হযরত আলী ও মাতা মোছা: বিউটি বেগম ।ছোটবেলা কেটেছে গ্রামের প্রকৃতির মাঝে ।
পড়ালেখার হাতেখড়ি একডালা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় । বাবা-মার প্রচন্ড আগ্রহই ছিল তার পড়ালেখার মূল অনুপ্রেরণা । মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল হারুন্জা নমিজন আফতাবী উচ্চ বিদ্যালয়, এই বিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে স্টার মার্কস পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।এরপর বগুড়া সরকারী আযিযুল হক কলেজ থেকে ২০০৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।
বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহের কারণেই চেস্টা ছিল সংশ্লিষ্ট কোন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স করা । ২০১০ সালে চট্রগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাঁচবছর মেয়াদি ‘ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন (DVM)’ ডিগ্রি অর্জন করেন । এরপর ২০১২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে ‘মাইক্রোবায়োলজি’ বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন । অনার্স এবং মাস্টার্স উভয় ডিগ্রিতেই সর্বোচ্চ ভাল ফলাফল করায় দুটিতে আলাদাভাব রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদকে ভূষিত হওয়ার সৌভাগ্য হয় জহুরুল ইসলামের ।
কর্মজীবন : ১ম চাকরির সুযোগ হয় ৩০তম বিসিএস-এ, কিন্তু একই সাথে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সুযোগ আসায় বিসিএস এর পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ সালে মাস্টার্স ছাত্র থাকা অবস্থায় প্রভাষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ২০১৪ সালে সহকারি অধ্যাপক এবং ২০১৮ সালে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো কর্মরত ।
বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি : মাস্টার্স শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতার পাশাপাশি বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি চলতে থাকে । যেহেতু আত্মীয় স্বজন বা পরিচিত কেউ এবিষয়ে সাহায্য করার ছিলনা, একমাত্র ভরসা ছিল ‘গুগল’ ! ইন্টারনেট ব্যবহার করেই বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও বৃওি প্রাপ্তির বিভিন্ন দিকনির্দেশনা অনুযায়ী প্রথমে IELTS পরীক্ষা দেন । এরপর ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকদের সাথে ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু করেন । অল্পকিছুদিনের মধ্যেই কানাডা আর ডেনমার্কের বিশ্বখ্যাত দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইন্টারভিউ-এর ডাক আসলো । ইন্টারভিউ দেয়ার দুসপ্তাহের মধ্যে ফলাফল পেলাম দুটোতেই স্কলারশিপসহ ডক্টরেট করার সুযোগ । এর মধ্যে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদেশের অর্থায়নে ফুল স্কলারশিপে পিএইচডি তে ভর্তি হন ২০১৫ সালে । পরবর্তিতে তার স্ত্রীও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়ায় পরিবারসহ ডেনমার্কে বসবাস করার সুযোগ হয় । ২০১৮ সালে ডক্টরেট শেষে ডেনমার্ক থেকে বাংলাদেশে এসে আবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতাই যোগদান করেন।
পোস্টডক্টরাল গবেষক হিসেবে হার্ভার্ডে যোগদান : একটি আন্তর্জাতিক ফেলোশিপ প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্টডক্টরাল বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করেন । এখনো স্বপ্নই মনে হয়, বাংলাদেশের ছোট একটা গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা শুরু করে পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা !যোগ করেন জহুরুল ইসলাম। বর্তমানে গবেষনা করছেন অনুজীব,মানুষ ও পশুপাখির নিবিড় সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে কিভাবে বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা আবিষ্কার করা যায় সে বিষয়ে ।
আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা: ২০১৫ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মাননা আসে ইউরোপিয়ান সোসাইটি ফর ক্লিনিক্যাল মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস হতে প্রাপ্ত কনফারেন্স এটেন্ডেড গ্রান্টসের মাধ্যমে । এরপর ২০১৬ সালে আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি (ASM) কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক আগার আর্ট (Agar Art) প্রতিযোগিতায় সারা পৃথিবীর মধ্যে সেরা প্রতিযোগী হিসেবে পুরস্কৃত হন । এ পুরস্কারের খবর পৃথিবীর নামকরা সংবাদ মাধ্যম ও বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ হয়, তাদের মধ্যে উল্যেখযোগ্য হলো বৃটেনের ‘দি গার্ডিয়ান’, জার্মানির ‘bild der Wisenchaf’, বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’ ও ‘নেচার’ । ২০১৭ সালে আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি কর্তৃক বাংলাদেশের জন্য তিন বছর মেয়াদে সায়েন্স এম্বাসেডর হিসেবে নিযুক্ত হই । এছাড়া ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ-ওরলিন্সে ও ২০১৯ সালে সানফ্রান্সিসকোতে ASM কর্তৃক প্রদত্ত ‘ASM microbe’ কনফারেন্স ট্রাভেল এওয়ার্ড পাই । সাম্প্রতিক ২০১৯ সালে ডেনমার্কের লুন্ডবেক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রদত্ত বহুল প্রতিযোগিতামুলক ‘আন্তর্জাতিক পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ’ অর্জন করেন যার অর্থায়নে বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন: দেড়-মাস ব্যাপী DVM-ইন্টার্ণশিপ ট্রেইনিং-এর উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে প্রথম বিদেশ গমনের সুযোগ হয় ভারতের মাদ্রাজ ভেটেরিনারি কলেজ ও তামিলনাড়ু ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে । এরপর ২০১৫ সালে ডেনমার্কে পিএইচডি চলাকালীন ও তৎপরবর্তি সময়ে পৃথিবীর ২৫টি দেশ ভ্রমন ও অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা হয় । তন্মধ্যে উল্যেখযোগ্য জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইডেন, হাংগেরী, অস্ট্রিয়া, ইতালী, দক্ষিন কোরিয়া, ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় । বিদেশে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গবেষনা উপস্থাপনা করেন দক্ষিন কোরিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি, ও যুক্তরাষ্ট্রে ।
বৈজ্ঞানিক গবেষনা ও প্রকাশনা: বিজ্ঞান গবেষনার হাতেখড়ি মাস্টার্স পড়ালেখার সময় থেকেই । মাস্টার্সের গবেষনা ফলাফল প্রকাশ হয় ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের জার্নাল ‘এপিডেমিওলজি এন্ড ইনফেকশন’ এ । ক্যরিয়ারের শুরু থেকেই আমার গবেষনার মূল বিষয় ছিল অনুজীবের সাথে মানুষ-পশুপাখির সম্পর্ক ও অনুজীবঘটিত রোগের বিস্তার । এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষনা প্রকাশনার সংখ্যা ১৫টি ।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা : যুক্তরাষ্ট্রে গবেষনা শেষে বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বড় পরিসরে গবেষনা করা ও অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে দেশের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান রাখা ।
পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি অনুপ্রেরণা : নিজের আগ্রহ, কঠোর পরিশ্রম আর কাজের প্রতি ভালবাসা খুব জরুরী । কোন বিষয়ে পড়ালেখা করছি, শহর না গ্রামে, ছেলে না মেয়ে এসব বিষয় কখনোই লক্ষ্যে পৌঁছার অন্তরায় নয় । আত্মবিশ্বাস, চেস্টা আর কঠোর পরিশ্রম অভিষ্ঠে পৌঁছার মূলমন্ত্র ।